সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কেমন আছে বর্ধমান শহর...( ছয় )

কেমন আছে বর্ধমান শহর...( ছয় )

কেমন ছিল জলনিকাশি ব্যবস্থা?
ভেবেছিলাম লেখার শেষে ব্যক্তিগত কিছু মতামত দেব- কেউ নিক বা না নিক। কুন্তলা গোলমাল করে দিল। কুন্তলা লাহিড়ী দত্ত। কুন্তলা এই সময়ে ANU অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে ও গবেষণায় ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করছে। ও এখন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী ও লেখিকা এবং বিভিন্ন মানবিক সমস্যা বিষয়ক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। ও যে যে বিষয়ে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী সে সে বিষয়ে আমি একেবারেই অজ্ঞ। অল্প যে কয়েকজন ‘বুদ্ধীজীবী’কে আমি সইতে পারি কুন্তলা তাদের মধ্যে আমার অন্যতম প্রিয় একজন মানুষ। মূলত ও ভূগোলের মানুষ। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিষয়ে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছে। বর্তমানে ওর বৌদ্ধিক বিচরণের ক্ষেত্র অনেক বেশি বিস্তৃত। দামোদর বেসিন নিয়ে কুন্তলা দীর্ঘদিন অনুসন্ধান, ফিল্ড স্টাডি ও গবেষণা করেছে। বর্ধমান নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় কুন্তলা নানাভাবে সাহায্য করতে পারতো। এই শহরটা কুন্তলারও বড় হয়ে ওঠার ধাত্রীভূমি। বাবা স্বনামধন্য অধ্যাপক হরশংকর ভট্টাচার্য। কিন্তু কুন্তলার সাহায্য নেবার প্রয়োজন কেউ অনুভবই করেন নি। ওর প্রিয় ছাত্রী তথা বন্ধু ডঃ গোপা সামন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ান এবং এই শহরেরই মানুষ। তার খোঁজও কেউ করেন না। কেন করেন না সে প্রসঙ্গে পরে আসব। আপাততঃ যে কথা বলছিলাম সেখানে ফিরে যাই।
গোলাপবাগকে একটি দ্বীপের আকার দিয়েছে যে লহরটি বা পরিখাটি তার উৎস এই শহরের উত্তর পশ্চিমের শেষ বিন্দু গোদা গ্রামের মাঠের একটি জলা। এই মাঠেই হেলথ সিটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল বিদায়ী বামফ্রন্ট সরকারের। হয় নি। এই মাঠের জলা থেকে জল বেড়িয়ে গোলাপবাগের চারদিকে খনন করা পরিখাটিকে জলের যোগান দেয়। অতিরিক্ত জল দুটি মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে গোলাপবাগ কখনো জলমগ্ন হয় না। একটি মুখের কথা আগেই পর্বে লিখেছি। এবার চলুন তারামন্ডলের কাছে যে মুখটা তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। তাকিয়ে দেখুন এখানে খালটির পাড় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। ফলে খালের প্রস্থ কমে গেছে। এই খালের পাড় দিয়ে চলুন পূব মুখে হেঁটে যাই। রমনা বনের ছায়াসুরভিত রাস্তা দিয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে যেতে অনেক পুরোনো কথা মনে পড়বে আমাদের মত এক্সট্রা ওভারে ব্যাট করা মানুষদের। রমনার রাস্তায় পা দিয়ে চারপা হেঁটেই ডানহাতে বিজয় বিহার। ইচ্ছে হলে ভিতরে দেখে আসতে পারেন। মহারাজাধিরাজ বিজয় চাঁদের সমাধিস্থল। একটা কারুকাজ করা মন্দির। বাঁধানো জলাশয় একটি। চারপাশে অসংখ্য গাছ, ফুল বাগিচা ও প্রাচীন আরণ্যক নীরবতা। মন শান্ত আপন অস্মিতাতে স্থিত হবে।
আমাকে চলতে হবে। রাস্তার পাশে কাঁঠালি চাঁপার সুগন্ধ ভেসে আসছে নাকে। মন উতলা হচ্ছে অতীত স্মৃতি রোমন্থনে। কিন্তু কর্তব্যের ডাক বড় নির্দয় কঠিন। এগিয়ে চলা যাক পায়ে পায়ে। অরণ্যর মায়াবী কুহক উপেক্ষা করেই। পৌঁছে গেলাম মূল বাবুর বাগে। ওই তো সেতু পেরোলেই শহীদ শিবশঙ্কর সেবাসমিতির বিশাল ভবন। কিন্তু সে জলা জমি কোথায় গেল? কোথায় হারিয়ে গেল সেই চওড়া খাল? অভিযাত্রীর অনুসন্ধিৎসা না থাকলে রাজার আমলের সেই স্বাভাবিক জলনিকাশি খালের চলাচলের পথ ও তার ক্যাচমেন্ট এরিয়া খুঁজে পাবেন না। বিত্তবান ও অভিজাত এবং কিছু টেনেটুনে জোগাড় করা মধ্যবিত্ত মানুষ মিলে এই খাল বুজিয়ে( প্রায় ) এখানে দেবতাদের মর্তের স্থায়ী আবাসস্থল বানিয়েছেন যার নাম- ইন্দ্রপ্রস্থ। একদা এদের অধিকাংশই রাজনীতি সচেতন ‘ভোকাল’ পাবলিক ছিলেন। এখন কে কোন কূলে বা মূলে আশ্রয় নিয়েছেন বা নিরাশ্রয় হয়েছেন সে খবরে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমি প্রাচীন স্বাভাবিক জলনিকাশি ব্যবস্থা কেমন ছিল তার অনুসন্ধান করছি। নেহরু বিদ্যামন্দিরে এসে একটু জিরিয়ে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি যে নাবাল জমি বর্ষায় জল থৈ থৈ করত সেখানে গড়ে উঠেছে আর একটি স্যাটেলাইট টাউনশিপ যার নাম নজরুল পল্লী। এই দুই বসতির মাঝখানে একটি পাকা রাস্তা নির্মিত হয়েছে জিটি রোডের সঙ্গে যুক্ত করে। আর নেহরু বিদ্যামন্দিরের গা দিয়ে অতন্ত্য সঙ্কোচের সঙ্গে বাবুর বাগের খালটি নর্দমার আকার নিয়ে বয়ে চলেছে একরাশ অভিমান ও পুতিগন্ধময় বর্জ্য পদার্থ বুকে নিয়ে। যে বছর বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে সে বছর ভাসিয়ে দিচ্ছে গোটা ইন্দ্রপ্রস্থ ও নজরুল পল্লী। কেন তার কারণ খুঁজতে আমাদের আরো কিছু অঞ্চল ঘুরে দেখতে হবে। এখানে একটা সহজ ভূগোলের উত্তর দিয়ে রাখি। ভুল হলে কুন্তলা, তুমি আমাকে শিখিয়ে দিও।
স্নেহ এবং জল সর্বদাই নিম্নগামী। স্নেহ ভূগোলের বিষয় নয় তাই দীপংকর বা সুতপা বা সুকন্যা বা পথিকৃৎ আমাকে ‘স্নেহ’ করতে পারেন কিন্তু জলের গতিপথকে জোর করে উল্টোদিকে প্রবাহিত করতে গেলেই সমূহ বিপদ। যতই না আমরা বিজ্ঞানের শক্তির বড়াই করি প্রকৃতিমা কারো বশে থাকেন না। মূল শহরের চারপাশটা ক্রমেই উঁচু করা হচ্ছে- বাম, ডান, তৃণমূল, ছিন্নমূল্‌ বিপ্লবী, প্রতিবিপ্লবী সব আমল জুড়েই। নানারকম প্রসাধন হচ্ছে কিন্তু শহরের নোংরা জল ও বৃষ্টির অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাবার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। গলা এবং ঘাড় ধাক্কা খেয়ে সে ফিরে এসে শহরটাকেই নোংরা জলে ডুবিয়ে দিচ্ছে। প্রতিবছর। একে প্রকৃতির প্রতিশোধ বলবেন কিনা বন্ধুরাই ভাবুন। ( চলবে )
#
[বি দ্রঃ ইন্দ্রপ্রস্থ ও নজরুল পল্লী নিয়ে একটি ভালো রিলিজিও-ডেমোগ্রাফিক স্টাডি হতে পারে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর মানসলোকের নির্মাণ ও বিনির্মাণ বুঝতে এই স্টাডি সাহায্য করবে। আমাদের অসাম্প্রদায়িকতা skin-deep – এই ধারণা আমার অনেকদিনের।]

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সত্যম বদ প্রিয়ম বদঃ অপ্রিয়ম সত্যম মা বদ

সত্যম বদ প্রিয়ম বদঃ অপ্রিয়ম সত্যম মা বদ ছোটো বয়সে সংস্কৃত ক্লাশে অনুবাদ করেছিলামঃ সত্যম বদ প্রিয়ম বদঃ অপ্রিয়ম সত্যম মা বদ। মনের মধ্যে খটকা এখনো লেগে আছে। সত্য সবসময় 'প্রিয়' হবে এমন কোনো মানে নেই। লোকের মন রাখতে গিয়ে মিথ্যে বা অর্ধ সত্যের চাষ করে যেতে হবে। তারপর আমরা একটা সুস্থ সমাজ চাইব!  মাঝে মাঝেই দেখি আমি হয়তো কোনো বন্ধুর পোষ্টে কিছু মন্তব্য করেছি যা সত্য কিন্তু তার মনঃপূত নয়। কিছুক্ষণ পর দেখি আমার মন্তব্য ডিলিট করে দিয়েছে। আমি হয়তো আর সেখানে কিছু মন্তব্য করব না বা তাকে আনফ্রেন্ড করব না ( তার স্তরে আমি কেন নামবো ?) কিন্ত সত্য কি ডিলিট করা যাবে? একটা তর্ক প্রায় শুনি- আমার সত্য বনা্ম তোমার সত্য। আমার হাসি পায়। সত্যের স্বরূপ তুমি- আমি -স্বাপেক্ষ নয়।

কেমন আছে শহর বর্ধমান ......(সাত)

কেমন আছে শহর বর্ধমান ......(সাত) বাঁকার সাথে পায়ে পায়ে এবার আমরা একটু অন্যপথে ঘুরতে বেরোব শহরটা। আমাদের অভিমানিনী বাঁকার সঙ্গে একটু আন্তরিক চেনাজানা করা দরকার। চলুন শহরের পশ্চিম দিকে একবার ঘুরে আসি। একটা সময় ছিল যখন একমাত্র বাঁকাই এই শহরের পানীয় জলের যোগান দিত। বেলকাশ ও ফেরীঘাটের উত্তর সীমানা দিয়ে বাঁকা বয়ে এসে রথতলা সাইফনের কাছে আরো ডানদিকে বাঁক নিয়ে রথতলাকে দক্ষিণে রেখে শহরে ঢুকেছে। এখানে বাঁকা এখনো ছোটো নদী। রথতলা ঢোকার আগে আর একটু ডানদিকে বাঁকার একটা ধারা বয়ে গেছে। মনে হয় এটা মানুষের কীর্তি । এখানেই জলকল। আরো উত্তরে বীরুটিকরি গ্রাম। এইখানে জল শোধন করে পাম্পের সাহায্যে শহরে পাঠানো হোত পানীয় জল। মূল এলাকার নাম লাকুরডি। এখন এই লাকুরডি ও জলকল-বীরুটিকুরি গ্রামের মাঝ বরাবর দুর্গাপুর হাইওয়ে বা বাইপাস চলে গেছে। আমরা রথতলা ও মোহন্ত স্থলের কাছে বাঁকাকে ছেড়ে লাকুরডির পথ ধরে টিকরহাটে ঢুকবো। লাকুরডি অঞ্চলের পূর্ব সীমানায় একটা আদ্যিকালের পুরোনো গাছ ও তার নীচে একটা মন্দির আছে। ঠিক তার পূর্ব সীমানা দিয়ে একটা ছোটো কাঁদর ঝিরিঝিরি বয়ে চলেছে দক্ষিণে বাঁকার দিকে। গোদার পশিম পারের মাঠের অতিরিক্ত...

কেমন আছে শহর বর্ধমান ?......( আপাতত শেষ পর্ব)

কেমন আছে শহর বর্ধমান ? ......( আপাতত শেষ পর্ব)  কিভাবে লুপ্তোদ্ধার সম্ভব? না, এই এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা শহরের লুপ্তোদ্ধার সম্ভব নয়। প্রথমেই এই কথাটা বলে রাখা ভাল। কিছু মেরামত করা সম্ভব। এখনই যদি সদর্থক উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে এই শহরের শ্রী ও স্বাস্থ কিছু পরিমাণে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ বিষয়ে নানাজনের সাথে আলোচনা করে আমার কিছু কথা মনে হয়েছে। এখানে সেই কথাগুলি সংক্ষেপে বলতে চাই। অনেকদিন ধরে নানাসূত্র থেকে আমি কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম। আমার অসাবধানতার কারণে আমার ল্যাপটপটি নিশিকুটুম্ব নিয়ে গেছে। আমার সংগৃহীত যাবতীয় তথ্যও সেইসঙ্গে চলে গেছে। ফলে তথ্যসহ কথা বলা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। আমি গত দুতিনদিন ধরে বর্ধমান মিউনিসিপ্যালিটী ও বর্ধমান ডেভেলপমেন্ট অথরিটির ওয়েবসাইট খুঁজলাম । দরকারী তথ্য পেলাম না। এই দুই সংস্থা আমাদের এই প্রিয় শহরের উন্নতির জন্য কি কি পরিকল্পনা রচনা করেছেন জানতে পারলে সুবিধা হোত। লক্ষ্য করে দেখবেন আমি আমার প্রতিবেদন ও ব্যাখ্যায় রাজনৈতিক দোষারোপের মধ্যে নিজেকে জড়াই নি। আমি বুঝেছি এই দোষ আমাদের সকলের। ব্যক্তি মানুষের লোভ ও স্বার্থচিন্তা সমানভাবে দায়ী এই শহরের এই বর্তমান অবস্থ...