কেমন আছে শহর বর্ধমান ?...( পাঁচ )
কেন তখন এই শহরে জল জমতো না?
সকলেই জানেন এই শহরে চারটি বড় দিঘী/সরোবর বা ‘সায়র’ খনন করিয়েছিলেন ‘রাজ’ পরিবারের লোকেরা। দীঘিগুলির নামের মধ্যেই এই পরিচয় বিধৃত হয়ে আছে। সবথেকে বড়টির নাম কৃষ্ণসায়র আর সব থেকে ছোটো দীঘিটির নাম কমল সায়র। এটি কেশবগঞ্জ চটীর কাছে অবস্থিত। এই দীঘির পূবপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ইঞ্জীনীয়ারিং কলেজটি। রাজ কলেজের সামনে শ্যামসায়র এবং আরো পূব দিকে অবস্থিত রাণীসায়র। এ ছাড়াও এই শহরে অসংখ্য ছোট বড় পুকুর ও জলাশয় ছিল। ছিল বলছি তার কারণ এদের মধ্যে অনেকগুলি বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। এ কথায় আসার আগে কিছু অন্য কথা সেরে নি।
বর্ধমান রাজবাড়ী ঠিক কতখানি যায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকেই হয়তো তার অনুমান করতে পারবেন না। একটু বর্ণনা করি। শহরের মাঝখান থেকে যে ঘড়ি দেখা যায় সেটা রাজবাড়ির পূর্ব দিক। এই ঘড়ির চৌকোনা গম্বুজটাকে ডান হাতে রেখে সোনাপট্টীর মধ্য দিয়ে শ্যামবাজারের সরু রাস্তা ঘরে চলুন হাঁটতে থাকি। রাস্তার দুপাশে সোনারূপোর গহনা প্রস্তুতকারক শিল্পীদের দোকান এখনো আছে। এই রাস্তার মাঝামাঝি এসে ডানদিকে লক্ষী নারায়ণ জীঊ মন্দির। ভিতরে ঢুকলে মনে হবে বুঝি অষ্টাদশ শতাব্দীর আবহের মধ্যে এসে পড়েছি। আমরা তাই ভিতরে যাব না। সোজা শ্যামবাজার রাস্তা ধরে দক্ষিণ দিকে ময়ুর মহলের রাস্তার মুখে এসে ডানদিকে বাঁক নিয়ে সোজা পশ্চিম দিকে পুরাতন চক, শের আফগান ও কুতুবুদ্দিনের যুগ্ম সমাধিকে বাঁদিকে রেখে হাঁটতে থাকব। ডানদিকে প্রথমেই দেখা হবে মহারাণী অধিরাণী বালিকা বিদ্যালয়ের। সুউচ্চ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা রাজবাড়িতে পাঁচিলের গায়ে পায়রার খোপ কাটা ছিল। প্রতদিন কয়েক হাজার পায়রা এখান থেকে আকাশে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যেত। আবার সন্ধ্যাবেলায় ফিরে এসে ঘরগেরস্থি করত। আজ এদের বংশধররা অন্য কোথাও শস্যদানা খুঁটে খাচ্ছে। আর একটু পা চালিয়ে এগিয়ে এসে ডান দিকে সুফী সাধক বাহারাম শিক্কার মাজার ( খক্কর সাহেবের দরগা নামে সমধিক পরিচিত)। তারপর বাঁদিকে শাহী মসজিদ রেখে সোজা নতুনগঞ্জ সাঁকারি পট্টীর মোড়ে এসে ডাণদিকে ঘুরে তিনমাথার মোড়ে আসব। আবারো ডানদিকে ঘুরে উত্তরফটক- রাজবাড়ির মূল প্রবেশ পথ। আমরা আরো খানিকটা এগিয়ে যাব উদয় চাঁদ মহিলা কলেজ পেরিয়ে আবার মিঠাপুকুর ও সোনা পট্টীর সংযোগস্থলে- যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। যদি সমস্ত রাজবাড়িটাকে একটা বৃত্ত রূপে কল্পনা করে নি তাহলে এই বৃত্তের পরিধি আনুমানিক আড়াই কিলোমিটার। আসলে কিন্তু এটা আয়ত ক্ষেত্রাকার। যে কথাটা বলার জন্য এই শিবের গীত গাওয়া তা হল এই যে এই রাজবাড়ির চারপাশে পাকা, চওড়া , গভীর নর্দমা ছিল। প্রবল বর্ষণেও কোথাও এক ফোঁটা জল জমত না। দক্ষিণপারের নর্দমাগুলির জল বাঁকায় গিয়ে পড়ত।
এবার উত্তরের কথায় আসা যাক। শুলি পুকুরের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি নানা বাঁক পেরিয়ে গোলাপবাগ বাঁদিকে রেখে জিটি রোড-কে ছুঁয়েছে একটু মনোযোগ দিয়ে সেটি লক্ষ্য করতে বলব সকল বন্ধুদের। রাজবাড়ির সামনের রাজার আমলের বড ড্রেনের বাড়তি জল চলে আসত শুলিপুকুরের রাস্তার ডানদিকের বড় ড্রেনে। সামন্ত বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষে এই হাইড্রেনটি চলে গেছে ঝাপানতলা হয়ে ধোবাপাড়ার পাশ দিয়ে শ্যামলালের মূল বড় ড্রেনটিতে গিয়ে মিশেছে। এখান থেকে এটি আর বাঁধানো রূপে নেই। শ্যামলাল কলোনীর পাশ দিয়ে, স্টুডেন্ট হেলথ হোমের গা দিয়ে এটি বাবুরবাগের পথ ধরেছে। তারপর কালিতলা হয়ে ইন্দ্রপ্রথের পাশ দিয়ে নেহরু বিদ্যালয়ের গা ঘেঁষে জিটি রোডের নীচে দিয়ে , সিটি হোটেলের নীচে দিয়ে বয়ে গেছে রেল লাইন পেরিয়ে সাবজলাতে মিশে যাবার জন্য। এবার একটু পিছিয়ে আবার শুলিপুকুরের পাড়ে ফিরে আসি। পুকুরটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের শেষ বিন্দুতে একটি জলবিভাজিকা নির্মিত ছিল। দক্ষ ইঞ্জীনীয়ার ছাড়া এমনটি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। প্রবল বর্ষণে শুলিপুকুর কখনোই উপচে যেত না- কারণ অতিরিক্ত জল এই জল্বিভাজিকার মধ্য দিয়ে মূল হাইড্রেনে গিয়ে পড়ত। ব্যবস্থা এমন সুন্দর ও বৈজ্ঞানিক ছিল যে বড় মাছ বেরিয়ে যেতে পারত না। বিভাজিকার মুখে শক্তপোক্ত জালি বসানো ছিল। তারপর সেই অতিরিক্ত জল উপরে বর্ণিত নির্দিষ্ট পথ বেয়ে সাবজলাতে পৌঁছে যেত।
এবার আসা যাক কৃষ্ণ সায়রের কথায়। ১৯৭৮ সালের প্রলয়ঙ্কর বন্যার সময় কৃষ্ণ সায়র প্রথমবার ( আমার জ্ঞানত ) প্লাবিত হয়। যারা পুরোনো মানুষ তারা আড়াঘাটের নাম শুনেছেন। মাঠে মাছ ধরার সময় ‘আড়া’ পাতা হয়। এই ঘাটে এমন সুন্দর জলবিভাজিকা তইরী করা ছিল যে কোনদিন এই দীঘির জল উপচে যায় নি। পুকুরটার গঠনই এমন ছিল যে জলের টান থাকত দক্ষিণ থেকে উত্তরে। প্রবল বর্ষণের অতিরিক্ত জল আড়াঘাটে জল্বিভাজিকার মধ্য দিয়ে ভূগর্ভস্থ পাকা ড্রেনে পড়তো। মাছ কিন্তু বেরোতে পারতো না। এই অতিরিক্ত জল মিশত রমনা বাগানের খালে। সেই জল বয়ে যেত এখনকার সাইন্স সেন্টারের পাশ দিয়ে গোলাবাগ থেকে বেরিয়ে আসা খালে। এখনকার রমনা রিজার্ভ ফরেস্টের বুক চিরে উত্তরপূর্ব কোনে গিয়ে সেই জলধারা মিশত বাবুরবাগ খালে। এই খালটি এসেছে গোলাবাগের উত্তরের গেটের পাশ দিয়ে মেঘনাদ সাহা তারামন্ডলের দক্ষিণ দিকের সীমানা স্পর্শ করে। ( এ বিষয়ে একটু বিস্তারে বলার ইচ্ছে পরের পর্বে )।
সুতরাং এই শহরের জলনিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে অতীতে কোন পরিকল্পনা ছিল না এটা মনগড়া কথা। সত্য নয়। এই শহরটাকে মুমূর্ষু বানিয়েছে আমরা স্বাধীনতার পর থেকে-গত সত্তর বছর ধরে। এখন এই শহরটি পনেরো মিনিট একটানা বর্ষণে নর্দমা-ভেনিস ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য জতুগৃহ। কংগ্রেস , বামফ্রন্ট তৃণমূল এবং আমরা উদাসীন ও লোভী নাগরিকরা সবাই দায়ী এ জন্য।এ আমাদের সম্মিলিত পাপ। ( চলবে )
বর্ধমান রাজবাড়ী ঠিক কতখানি যায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকেই হয়তো তার অনুমান করতে পারবেন না। একটু বর্ণনা করি। শহরের মাঝখান থেকে যে ঘড়ি দেখা যায় সেটা রাজবাড়ির পূর্ব দিক। এই ঘড়ির চৌকোনা গম্বুজটাকে ডান হাতে রেখে সোনাপট্টীর মধ্য দিয়ে শ্যামবাজারের সরু রাস্তা ঘরে চলুন হাঁটতে থাকি। রাস্তার দুপাশে সোনারূপোর গহনা প্রস্তুতকারক শিল্পীদের দোকান এখনো আছে। এই রাস্তার মাঝামাঝি এসে ডানদিকে লক্ষী নারায়ণ জীঊ মন্দির। ভিতরে ঢুকলে মনে হবে বুঝি অষ্টাদশ শতাব্দীর আবহের মধ্যে এসে পড়েছি। আমরা তাই ভিতরে যাব না। সোজা শ্যামবাজার রাস্তা ধরে দক্ষিণ দিকে ময়ুর মহলের রাস্তার মুখে এসে ডানদিকে বাঁক নিয়ে সোজা পশ্চিম দিকে পুরাতন চক, শের আফগান ও কুতুবুদ্দিনের যুগ্ম সমাধিকে বাঁদিকে রেখে হাঁটতে থাকব। ডানদিকে প্রথমেই দেখা হবে মহারাণী অধিরাণী বালিকা বিদ্যালয়ের। সুউচ্চ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা রাজবাড়িতে পাঁচিলের গায়ে পায়রার খোপ কাটা ছিল। প্রতদিন কয়েক হাজার পায়রা এখান থেকে আকাশে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যেত। আবার সন্ধ্যাবেলায় ফিরে এসে ঘরগেরস্থি করত। আজ এদের বংশধররা অন্য কোথাও শস্যদানা খুঁটে খাচ্ছে। আর একটু পা চালিয়ে এগিয়ে এসে ডান দিকে সুফী সাধক বাহারাম শিক্কার মাজার ( খক্কর সাহেবের দরগা নামে সমধিক পরিচিত)। তারপর বাঁদিকে শাহী মসজিদ রেখে সোজা নতুনগঞ্জ সাঁকারি পট্টীর মোড়ে এসে ডাণদিকে ঘুরে তিনমাথার মোড়ে আসব। আবারো ডানদিকে ঘুরে উত্তরফটক- রাজবাড়ির মূল প্রবেশ পথ। আমরা আরো খানিকটা এগিয়ে যাব উদয় চাঁদ মহিলা কলেজ পেরিয়ে আবার মিঠাপুকুর ও সোনা পট্টীর সংযোগস্থলে- যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। যদি সমস্ত রাজবাড়িটাকে একটা বৃত্ত রূপে কল্পনা করে নি তাহলে এই বৃত্তের পরিধি আনুমানিক আড়াই কিলোমিটার। আসলে কিন্তু এটা আয়ত ক্ষেত্রাকার। যে কথাটা বলার জন্য এই শিবের গীত গাওয়া তা হল এই যে এই রাজবাড়ির চারপাশে পাকা, চওড়া , গভীর নর্দমা ছিল। প্রবল বর্ষণেও কোথাও এক ফোঁটা জল জমত না। দক্ষিণপারের নর্দমাগুলির জল বাঁকায় গিয়ে পড়ত।
এবার উত্তরের কথায় আসা যাক। শুলি পুকুরের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি নানা বাঁক পেরিয়ে গোলাপবাগ বাঁদিকে রেখে জিটি রোড-কে ছুঁয়েছে একটু মনোযোগ দিয়ে সেটি লক্ষ্য করতে বলব সকল বন্ধুদের। রাজবাড়ির সামনের রাজার আমলের বড ড্রেনের বাড়তি জল চলে আসত শুলিপুকুরের রাস্তার ডানদিকের বড় ড্রেনে। সামন্ত বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষে এই হাইড্রেনটি চলে গেছে ঝাপানতলা হয়ে ধোবাপাড়ার পাশ দিয়ে শ্যামলালের মূল বড় ড্রেনটিতে গিয়ে মিশেছে। এখান থেকে এটি আর বাঁধানো রূপে নেই। শ্যামলাল কলোনীর পাশ দিয়ে, স্টুডেন্ট হেলথ হোমের গা দিয়ে এটি বাবুরবাগের পথ ধরেছে। তারপর কালিতলা হয়ে ইন্দ্রপ্রথের পাশ দিয়ে নেহরু বিদ্যালয়ের গা ঘেঁষে জিটি রোডের নীচে দিয়ে , সিটি হোটেলের নীচে দিয়ে বয়ে গেছে রেল লাইন পেরিয়ে সাবজলাতে মিশে যাবার জন্য। এবার একটু পিছিয়ে আবার শুলিপুকুরের পাড়ে ফিরে আসি। পুকুরটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের শেষ বিন্দুতে একটি জলবিভাজিকা নির্মিত ছিল। দক্ষ ইঞ্জীনীয়ার ছাড়া এমনটি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। প্রবল বর্ষণে শুলিপুকুর কখনোই উপচে যেত না- কারণ অতিরিক্ত জল এই জল্বিভাজিকার মধ্য দিয়ে মূল হাইড্রেনে গিয়ে পড়ত। ব্যবস্থা এমন সুন্দর ও বৈজ্ঞানিক ছিল যে বড় মাছ বেরিয়ে যেতে পারত না। বিভাজিকার মুখে শক্তপোক্ত জালি বসানো ছিল। তারপর সেই অতিরিক্ত জল উপরে বর্ণিত নির্দিষ্ট পথ বেয়ে সাবজলাতে পৌঁছে যেত।
এবার আসা যাক কৃষ্ণ সায়রের কথায়। ১৯৭৮ সালের প্রলয়ঙ্কর বন্যার সময় কৃষ্ণ সায়র প্রথমবার ( আমার জ্ঞানত ) প্লাবিত হয়। যারা পুরোনো মানুষ তারা আড়াঘাটের নাম শুনেছেন। মাঠে মাছ ধরার সময় ‘আড়া’ পাতা হয়। এই ঘাটে এমন সুন্দর জলবিভাজিকা তইরী করা ছিল যে কোনদিন এই দীঘির জল উপচে যায় নি। পুকুরটার গঠনই এমন ছিল যে জলের টান থাকত দক্ষিণ থেকে উত্তরে। প্রবল বর্ষণের অতিরিক্ত জল আড়াঘাটে জল্বিভাজিকার মধ্য দিয়ে ভূগর্ভস্থ পাকা ড্রেনে পড়তো। মাছ কিন্তু বেরোতে পারতো না। এই অতিরিক্ত জল মিশত রমনা বাগানের খালে। সেই জল বয়ে যেত এখনকার সাইন্স সেন্টারের পাশ দিয়ে গোলাবাগ থেকে বেরিয়ে আসা খালে। এখনকার রমনা রিজার্ভ ফরেস্টের বুক চিরে উত্তরপূর্ব কোনে গিয়ে সেই জলধারা মিশত বাবুরবাগ খালে। এই খালটি এসেছে গোলাবাগের উত্তরের গেটের পাশ দিয়ে মেঘনাদ সাহা তারামন্ডলের দক্ষিণ দিকের সীমানা স্পর্শ করে। ( এ বিষয়ে একটু বিস্তারে বলার ইচ্ছে পরের পর্বে )।
সুতরাং এই শহরের জলনিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে অতীতে কোন পরিকল্পনা ছিল না এটা মনগড়া কথা। সত্য নয়। এই শহরটাকে মুমূর্ষু বানিয়েছে আমরা স্বাধীনতার পর থেকে-গত সত্তর বছর ধরে। এখন এই শহরটি পনেরো মিনিট একটানা বর্ষণে নর্দমা-ভেনিস ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য জতুগৃহ। কংগ্রেস , বামফ্রন্ট তৃণমূল এবং আমরা উদাসীন ও লোভী নাগরিকরা সবাই দায়ী এ জন্য।এ আমাদের সম্মিলিত পাপ। ( চলবে )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন