স্বপ্ন-পূরান বা ইনফ্যাচুয়েশন
-ঈশ্বর পাটনী
-এই মেয়ে , তন্ময় হয়ে কি ভাবছ? আমার কথা?
মেয়েটি আপন মনে পড়ছিল। সামনে সেমিস্টার আছে। টিপটিপ করে সারা সন্ধ্যে বৃষ্টি পড়ছে। বিকেল থেকে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হওয়া পর্যন্ত একই যায়গায় বসে আছে সে। বৃষ্টি বাড়ছে কমছে। মনের মধ্যে একটা গান অনেকক্ষণ আসাযাওয়া করছে। ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে...’। গলা ছেড়ে গাইতে পারছে না। পড়ায় মন দিতে হচ্ছে তাই। কিন্তু এই জলদগম্ভীর কন্ঠস্বর কার? সে তো দরজা বন্ধ করেই পড়ছে! সেই মা যখন খেতে ডাকবে তখন সে দরজা খুলবে। বন্ধ ঘরে তো কারো ঢোকার কথা নয়। তাহলে কি সে ভুল শুনেছে?
-কি ভাবছ?
এবার সত্যিই চমকে উঠলো পৃথা । ঠিক কানের কাছেই কেউ যেনও কথা বলছে তার সঙ্গে। আর গলাটাও খুব চেনা। কিন্তু এই বৃষ্টির রাতে তার ঘরে কোন মানুষের আসার কথাই নয়। আর একটা ব্যাপার। তিনি স্বর্গে গেছেন তার জন্মের আগে। তাহলে কিভাবে তিনি আসতে পারেন এই সময়ে তার পড়ার ঘরে? পৃথা টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। ঘরের টিউব লাইট জ্বালিয়ে দিল। না কেউ কোত্থাও নেই। একেই কি বিভ্রম বলে? পড়ার টেনশন থেকে এমন হতে পারে। হয়তো তার পড়তে ভাল লাগছে না। মনে মনে এস্কেপ করতে চাইছে। আর এস্কেপ করার তার দুটো যায়গাই আছে। এক -গান আর নয়তো সত্যজিৎ। তার বেশিরভাগ বন্ধুর বয় ফ্রেন্ড আছে। সেই বয়ফ্রেন্ডই তাদের এসকেপ রুট। দেবু মানে দেবলিনা বলে টাইম পাস। ক্লাশ নাইনের শেষের দিক থেকে নানাজনের কাছ থেকে প্রস্তাব এসেছে কিন্তু সে মোটেই আগ্রহী নয়। এজন্য আড়ালে তাকে অনেকে পিসি বলে। তার কিছু যায় আসে না। এইসব ফালতু টাইম পাস থেকে সত্যজিতে ডুবে যাওয়া অনেক আনন্দের।
- তুমি শুনলাম ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলেছ আমার নামে?
না এবার পৃথার একটু ভয় ভয় করছে। এ খবরটাও পৌঁছে গেছে ওঁর কাছে? কিভাবে গেল? ওখানেও কি এখন ইন্টারনেট চালু হয়েছে?
-একটু ঘাবড়ে গেছ মনে হচ্ছ?
-সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? এতক্ষণে কিছু একটা কথা বেরোল মুখ থেকে।
- ফেলুদা কি বলে? ঘাবড়ে যাওয়া কি স্বাভাবিক মনে করত ফেলু মিত্তির?
-সে আপনি জানেন। ফেলু মিত্তির তো আপনার সৃষ্টি ।
-মোটেই না। আমি কাউকে সৃষ্টি করি নি। ওরা নিজেদের খুশিতেই এসে হাজির হয়েছে।
-ঠিক বুঝলাম না। ফেলুদা, তপসে , জটায়ু এরা আপনার সৃষ্ট চরিত্র নয়?
-একটা অন্য কথা বলা যাক। তুমি অঙ্ক পছন্দ কর?
-খুব
-তুমি অঙ্কের প্রব্লেমগুলো বানিয়েছো?
-না, সে আবার হয় নাকি?
-কেন হবে না? ধর তুমি অনেকদিন ধরে অঙ্ক কষতে কষতে একদিন নিজেই কিছু নতুন ফর্মুলা বানিয়ে ফেললে। এমন হতে পারে তো?
পৃথা ভেবে দেখল কথাটা সত্যি। জ্ঞান তো এভাবেই বাড়ে। সে তাই বলল-
-হতে পারে। ঠিক বলছেন আপনি।
-ফেলু মিত্তিরও ওইভাবে এসে হাজির হয়েছে।
-আপনি খুব ডিটেকটিভ গল্প পড়তে ভালবাসতেন?
-অবশ্যই। তুমি বাসো না?
-তা আর বলতে? ফেলুদা সিরিজের সব কটা বই আমি অনেকবার করে পড়েছি।
-ফেলুদা সিরিজ? আমার তো ফেলুদা নয়। হাহাহাহা। হ্যাঁ প্রদোষ মিত্র বলতে পারো। ফেলু তোমার খুব পছন্দ?
-দারুণ! কিন্তু একটা ব্যাপার আমার পছন্দ নয়। এতো সিগারেট খায় কেন?
-একটা কারণ আছে। কাউকে যদি না বল তাহলে চুপিচুপি তোমাকে বলি।
-না, কাউকে বলব না কিন্ত একটা সমস্যা আছে। দুজনকে বলতে হবে। দেবু আর দেবীকে বলতে হবে।
-ও হো , বুঝেছি-ত্রিনয়নীর বাকি দুজন।
-আপনি কি করে জানলেন?
-আমি জানি। কিভাবে জানি সে অবান্তর কথা। এই যেমন তুমি গান গাও সুন্দর। কিভাবে গাও জানো? আমি তো গাইতে জানি না।
-আপনি আমার সাথে মজা করছেন। আপনি একজন বিশ্ববিখ্যাত সংগীত পরিচালক। আর গান জানেন না?
-রমাকান্ত আচরেকারের নাম শুনেছো?
-শোনা শোনা লাগছে কিন্তু প্লেস করতে পারছি না।
-শচীন তেন্ডুলকরের কোচ। নিজে এমন কিছু খেলোয়াড় ছিলেন না। আমিও ওই রকম। সঙ্গীত পরিচালনা করেছি কিন্তু নিজে গাইতে জানতাম না। তবে প্রচুর গান শুনেছি।
-বিদেশী অর্কেস্ট্রা মিউজিক বেশী শুনেছেন পড়েছি। গান শোনার খুব নেশা ছিল আপনার। বাক, মোৎজারত, আর একজন রাশিয়ান- কি যেন নাম মনে পড়ছে না।
-ঠিক। তবে বাংলাগানের মধ্যেই আমি কিন্তু বড় হয়ে উঠেছি। রবীন্দ্র সঙ্গীত , ব্রাহ্ম সঙ্গীত
-জানি
-খুব মুস্কিলে ফেললে তো তুমি! যা বলছি বলছ -জানি।
-না মানে আমি বলতে চাইছি যে আমি এসব কথা পড়েছি। এবার বলুন চুপিচুপি কি কথা বলতে চাইছিলেন।
-ওই সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা। ফেলু মিত্তির কেন এত সিগারেট খায়
-ও এই ব্যাপার! জানি তো! আপনি নিজে এত স্মোক করেন বলেই ফেলুদাকে সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছেন।
-আমি শিখিয়েছি?
- তা নয় তো কি?
-উড়ে বাব্বা! তুমি তো বেশ বকুনি দিতেও পারো।!!
-দেখুন কাজটা মোটেই ভাল করেন নি। সিগারেট খওয়া মোটেই ভাল নয়।
-দেখ, সিগারেট ছাড়া আমি এত কাজ করতে পারতাম না।
-রবীন্দ্রনাথ সিগারেট খেতেন? সক্রেতিস? বুদ্ধদেব?
-আমি চললাম। এই সব মানুষদের সাথে আমার কোন তুলনাই হবে না।
-না না, ও কথা থাক। তাছাড়া এখন বলে লাভও নেই। আপনি তো----
-ও তাইতো- আমি তো নেই! তাহলে তুমি এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছো?
পৃথা মুস্কিলে পড়ে গেল। ঘরে তো কেউ নেই। কার সঙ্গে কথা বলছে সে? কিন্তু দিব্যি সবকথা শুনতে পেয়েছে সে। আচ্ছা, একটা ফোন করলে কেমন হয় দেবুকে? জেগে আছে কি এখন? কত রাত হবে? ঘড়ির কাঁটা চলছে না। ব্যাটারীব বদলাতে হবে। দেবী কি হস্টেলে? না, তার ইদানিং খুব ভুল হচ্ছে- দেবু হস্টেলে থাকে কিন্তু দেবী পিজি থাকে। বন্ধুরা দেবু শুনলে ভাবে বুঝি কোন ছেলের নাম। পৃথা মুচকি হাসে। একটু রহস্য থাকা ভাল জীবনে। এই তো সেদিন ফারজানা জিজ্ঞেস করছিল,’ হ্যাঁরে , তুই প্রায়ই দেবুর সাথে কথা বলিস। তোর নতুন বয়ফ্রেন্ড?’’ পৃথা হেসে বলে,’ নতুন বল আর পুরোনো বল , আমার ওই একটাই ---‘
-কি করে?
-এগ্রিকালচার পড়ে।
-শেষে আর কিছু পেলি না? এগ্রিকালচার? আর কোনো কালচার পেলি না?
-তাই বলে জোটে না! তাও একজন জোর করে জুটিয়ে দিয়েছে, তাই।
না, এদের অন্য কিছু বুঝিয়ে লাভ নেই। এদের চিন্তাভাবনা একমাত্রিক- ওয়ান ডাইমেনশনাল। ছেলে বন্ধু মানেই বয় ফ্রেন্ড। আর দেবু মানেই ছেলে! হাহাহাহাহা। দেবুকে বলায় তার হাসি আর থামেই না। অবশ্য একটা কথা বলতেই হবে- দেবু আসলে একটি টমবয়। যা সব কান্ডকারখানা করে। এইতো সেদিন কুকুরের কান মুলে দিয়েছিল।
দেবুকে ফোন ঘোরালো। বেজেই যাচ্ছে । হয়তো ও ঘুমিয়ে পড়েছে। দেবীকে ট্রাই করল। একই অবস্থা। বেজেই চলেছে ওদের ফোন।
-হ্যালো স্যর, আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমার গলা? আপনি মানে সত্যজিৎ রায় -শুনতে পাচ্ছেন আমার গলা?
না, কোন সাড়া নেই। সিগারেট খাওয়া নিয়ে অত কথা না বললেই হোত। তার একটা গভীর দুঃখ ছিল -কেন সত্যজিতের সঙ্গে একবার দেখা হোল না! অবশেষে তিনি নিজে এসে হাজির হলেন আর সে কিনা সিগারেট নিয়ে কড়া কথা শুনিয়ে দিল! এটাও কি এক ধরণের গোঁড়ামি নয়?
-তুই বড্ড বাড়াবাড়ি করিস, পৃথা । দেখবি তোর বরও সিগারেট খায়। কি করবি তখন? দেবী বলেছিল একদিন।
দেবুও সায় দিয়েছিল।
-আমার তো খুব ইচ্ছে করে খেয়ে দেখতে। কেন ছেলেরা সিগারেট খায় জানতে চাই বুঝতে চাই। দেবুকে থামিয়ে দিয়ে পৃথা বলেছিল-কেন লোকে খুন করে সেটা বোঝার জন্য তুই কি খুন করে দেখবি? আর আমার বরের কথা বলছিস? বিয়েই করব না তো বর আসবে কোত্থেকে?
-ঠিক বলেছিস ওসব ঝামেলার মধ্যে না যাওয়াই ভাল। দেবু পৃথাকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু দেবী মিটিমিটি হাসছিল।
-তুই অমন পিত্তি জ্বলানো হাসছিস কেন রে? পৃথা খুব রেগে গিয়েছিল। দেবী হাসতে হাসতেই বলেছিলঃ এই বয়সে বেশিরভাগ মেয়েই বলে বিয়ে কোরব না। কিন্তু একবার ভেবে দেখ আমাদের মায়েরাও এই বয়সে তোর মতই ভেবেছিল। বাস্তবে যদি বিয়ে না করত আমরা আসতাম কিভাবে এই পৃথিবীতে ? সবাই যদি এ ব্যাপারে সিরিয়াস হয় একদিন পৃথিবী থেকে মানব প্রজাতি মানে হোমো সাপিয়েন্স বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
-যাবে তো যাবে। আমার বয়েই গেছে মানব প্রজাতিকে রক্ষা করার জন্য বিয়ে করতে। দেবু ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠল। ওর বলার ধরনে সকলেই হো হো করে হেসে ফেললো ।
কিন্তু সত্যজিৎ কোথায় গেলেন? এ বড় অন্যায়। এভাবে আসতেই বা কে বলেছিল আর এলেনই যখন এরকম রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যাবার দরকার ছিল কি?
-আমাকে তুমি ডেকেছিলে তাই তো এসেছি। আর উধাও তো হয়ে যাই নি- তোমাদের তিন বন্ধুর কথা শুনছিলাম।
-আপনি সব শুনেছেন?
-হ্যা-আ-আ। দেবলিনা থুড়ি তোমাদের দেবুটা বদ্ধ পাগল মনে হোল। খানিকটা তোমার মত। কুকুরের কান মূলে দেবার কথাটা সত্যি? বেশ মজাদার মেয়ে তো।
-না না, ও কান মূলে দেয় নি। একটা কুকুর ওকে কামড়ে আঁচড়ে দিয়েছিল। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা ওকে ক্ষেপাই যে -তুই নিশ্চয় কুকুরটার কান মূলে দিয়েছিলি। শুনলেই ও ক্ষেপে যায়।
-তোমার মতই পাগল দেখছি।
-আমি পাগল? এমন বলতে পারলেন?
-হ্যাঁ , পারলাম । কারণ সত্য কথা বলা উচিত। ওই মেয়েটা, মা লক্ষীর মত মুখখানা- দেবাঙ্গী ও খানিকটা স্বাভাবিক মনে হল।
-দেবী? স্বাভাবিক?
-তুলনামুলকভাবে। কোনো সত্যই এবসলিউট নয়। তোমাদের তুলনায় স্বাভাবিক। যেমন ধর---
-যেমন?
-যেমন ও তোমাদের দুজনের মত এন্টি-বিয়ে নয়
-তার মানে আপনি বিয়ে সমর্থন করেন?
-অবশ্যই-তবে মানব প্রজাতির জন্য নয়- নিজের জন্য।
-আমাকে পাগল মনে হয় আপনার? কি দেখে পাগল মনে হয়?
-বলতে পারি যদি রাগ না কর।
-না, রাগ কোরব না। আমি পাগল নই।
-সব পাগলই তাই মনে করে। তোমাদের দেবুও। যাক গে তর্কে তর্ক বাড়বে মাত্র। কাজের কথায় আসি। তুমি কেন পাগল তাই বলি
-বলুন। আমি জানি আমি পাগল নই
-হাহাহাহাহাহা। একদম ঠিক কথা। একটা মেয়ে- টীনেজার- সে তার বড় হয়ে ওঠার সময় আমাকে হিরো ওয়ারশিপ করতে শুরু করল। এটা পাগলামি নয়? আমি আর দ্বিতীয় কোন মেয়ের সন্ধান পাই নি যে তোমার মত
-আপনি এটাকে পাগলামি মনে করেন?
-নয়?
- না, একে বলে মুগ্ধতা। আপনার প্রতিভাকে আমি সম্মান করি। এটা এক ধরণের হিরোওয়ারশিপ বলতেও পারেন কিন্তু আপনি জা ভাবছেন মোটেই তা নয়।
-ইন্টারেস্টিং! বেশ আমি কি ভাবছি তাই বল। আমার বেশ লাগছে তোমার সাথে কথা বলতে।
-আপনি ভাবছেন এটা আপনার প্রতি আমার ইনফ্যাচুয়েশান
-নয়?
-না। শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতা মানেই ইনফ্যাচুয়েশন নয়
-আচ্ছা ধর, যদি এমন হোত যে আমার সাথে তোমার দেখা হয়ে গেল - তুমি কি চাইতে আমার কাছে?
পৃথা এবার মুস্কিলে পড়ল। তাই তো যদি তাই হোত তাহলে কি চাইত সে?
-কি হোল? উত্তর নেই যে। কি চাইতে তুমি?
-আপনার সহকারী হতে চাইতাম। কাজ শিখতাম।
-আমি যদি তোমাকে কোন একটা ছবিতে রোল দিতে চাইতাম তুমি কোন রোল চাইতে?
-নায়ক ছবিতে শরমিলা ঠাকুরের রোল চাইতাম।
-ইন্টারেস্টিং।
-যখন আরো ছোট ছিলে -ধরো আট বা নয় বছর বয়সে তখন যদি বলতাম দুর্গার চরিত্রে অভিনয় কর - রাজী হতে?
-না।
-না? দুর্গাকে তোমার পছন্দ নয়?
-পথের পাঁচালি দেখে এখনো আমি কাঁদি। দুর্গাকে মেরে দিলেন কেন?
-আমি? বিভূতিবাবুকে বল। আমি কেন মেরে দেব?
-আপনি তো বদলে নিতে পারতেন গল্পটা।
-বিভূতিভূষণের লেখা আমি বদলে নেব? আমি কি পাগল? তাছাড়া পথের পাঁচালিতে প্যাথোজ- বিষণ্ণতা মূল সুর। সেটা বাদ দিলে ছবির প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না।
-তা না হয় হোল। বুঝলাম আপনার কথা। কিন্তু এর সঙ্গে আমার পাগল হবার কি সম্পর্ক?
-ইনফ্যাচুয়েশন
-বললাম তো ওটা মুগ্ধতা
-মানব সম্পর্ক অনেক জটিল। ইংরাজিতে বললে layered । আমরা যা বুঝি বা বুঝি বলে মনে করি অনেক সময়ই সেটা পুরো সত্য নয়। আর একটু বয়স হোক বুঝবে হয়তো।
-আমি এখন সাবালিকা। আঠেরো পেরিয়েছে
-হাহাহাহাহা। এইটা খুব মজার কথা। তোমার কোন কোন বান্ধবীর চার বা পাঁচ নম্বর রিলেশান চলছে আর তোমার একটাও নেই। তুমি এডাল্ট?
-এডাল্ট হবার সাথে এসবের সম্পর্ক কি?
-এডাল্ট হলে এই প্রশ্নটাই করতে না। আমার নামে তুমি একটা গ্রুপ খুলেছ। কখন? তোমার জন্মের আগেই আমি নেই এই পৃথিবীতে । তুমি তন্ন তন্ন করে আমার খোঁজ খবর নিয়েছ । সব বই পড়েছ। সিনেমা দেখেছো। আমার ছবির গানগুলি গলায় তুলেছ। ইনফ্যাচুয়েশন নয়?
-বেশ । আর কি কি কারণে আমাকে পাগল মনে হয়?
-একটা প্রশ্ন করি?
-করুন।
-এডমান্ড ফ্রয়েডের নাম শুনেছো?
-হ্যাঁ , ওই নামই শুনেছি। আমাদের এক স্যরের কাছে। কিছু পড়ি নি।
-বড় হয়ে ওর একটা বই যদি পারো পড়ে নিও- দি ইন্টারপ্রিটেশান অফ ড্রিমস বা দি সাইকোলজি অফ ড্রিমস।
-নিশ্চয় পড়ব। আমি তো বড় হয়েই গেছি।
-সে তো বুঝতেই পারছি- তুমি দেবু -তোমরা ‘বড়’ হয়ে গেছ। দেবুরও কোনো বয় ফ্রেন্ড জোটেনি শুনলাম।
-আমি বুঝতে পারছি না বড় হবার সঙ্গে বয় ফ্রেন্ডের সম্পর্ক কি!
-কারণ তুমি বড় হও নি। আঠেরো বছরে পা দিলেই কেউ বড় হয়ে যায় না আপনা আপনি- মানে অটোমেটিক্যালি।
-আমি মানতে পারলাম না। আইন বলছে যে আমি এডাল্ট হয়েছি।
-তুমি আমাকে খুব রেস্পেক্ট কর, তাই তো?
-সে তো অবশ্যই।
-যদি বলি আসলে তুমি আমাকে শ্রদ্ধা কর না। ফেলুদার গল্প তোমার ভাল লাগে। আমার কিছু সিনেমা তোমার ভাল লাগে আর আমার সুর দেওয়া গানগুলি তোমার ভাল লাগে। সে তো অনেকেরই লাগে। কিন্তু এতে বোঝায় না যে তুমি আমাকে শ্রদ্ধা কর, অন্যরকম মানুষ মনে কর যে অন্যদের থেকে আলাদা।
-আপনি ঠিক বলছেন না। আমি সত্যিই আপনার গুণমুগ্ধ। আমার সব বন্ধুরা জানে।
-সেতো আমিও জানি আর তা জানি বলেই তো আমি তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি। কিন্তু তুমি আমাকে শ্রদ্ধা কর না
-কি করে বুঝলেন? পৃথা মনঃক্ষুণ্ণ হল। একটু রাগও হোল তার।
-রাগ করবে না তো?
-না।
-তুমি কাপুরুষ ও মহাপুরুষ দেখেছ?
-না
-আগন্তুক?
-হ্যাঁ ।কিন্তু কেন এপ্রশ্ন করছেন?
-এই দুটি ছবিতে ধর্ম , ঈশ্বর ও কুসংস্কার সম্পর্কে আমার মতামত বলার চেষ্টা করেছি। তুমি আধুনিক যুগের মেয়ে হয়েও তাবিজকবচ পর। তার মানে কি ডাঁড়ায় ?
-দেখুন , আমি এসবে বিশ্বাস করি না কিন্তু মাবাবার বিশ্বাসে আমি আঘাত দিতে চাই না তাই পরি।
-দ্বিচারিতা নয় এটা?
-আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি যদি অনুমতি দেন
-অবশ্যই
-আপনি ব্রাহ্ম ধর্মে আস্থাশীল?
-হ্যাঁ
-কারণ আপনাদের পরিবার ব্রাহ্ম, তাই তো?
-এবার বুঝেছি তুমি বেশ তর্কও করতে পারো।
-আর একটা কথা-সিগারেট খাওয়া স্বাস্থের পক্ষে খারাপ জেনেও আপনি দিব্যি সিগারেট খেতেন এবং ফেলুদাকেও সিগারেট ধরিয়েছেন। এটা দ্বিচারিতা নয়?
কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পেল না পৃথা। কেমন এক ঘোরের মধ্যে আছে সে। স্বপ্নেও কোনদিন ভাবে নি যে এভাবে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কথা হবে তার। একটা স্বপ্ন অন্তত পূর্ণ হোল তার। একটা হ্যান্ডশেক করতে পারলে জীবন সার্থক হয়ে যেত। সে তো আর সম্ভব নয়। কিন্তু উনি যে বললেন ওনার প্রতি তার ইনফ্যাচুয়েশন আছে এই ব্যাপারটা নিয়ে তার কিছু পরিমানে দ্বিধা আছে। হ্যাঁ একথা সত্যি যে সত্যজিৎ রায়ের সে ফ্যান- শুধু ফ্যান নয় একনিষ্ঠ ফ্যান। যে মানুষটা ফেলুদার গল্প লেখেন, গুপী গায়েন বাঘা বায়েন এর মত কালজয়ী সিনেমা সৃষ্টি করেন , এত সুন্দর সুর দেন গানের, এত চমৎকার স্কেচ আঁকেন , আরো কত প্রতিভা তার- তার অনুরাগী হওয়াটা গর্বের। কিন্তু ইনফ্যাচুয়েশন? পৃথা সিওর নয়। সিগম্যান্ড ফ্রয়েড তার পড়া নেই। একটা কথা সত্যজিত ঠিক বলেছেন- সব সম্পর্কই লেয়ারড- একাধিক স্তর আছে। কোনটায় স্তরবিন্যাস বেশি কোনটায় কম।
না, স্বীকার করতে দোষ নেই । ইনফ্যাচুয়েশন হতেও পারে। খারাপ কিছু নয়। কোথায় যেন পড়েছে সে যে আমরা বড় হই মানে নানা স্তরের সম্পর্কের তানাবানার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে করতে যাই। ফ্রয়েড সাহেব তো আরো সব মারাত্মক কথা বলেছেন। ইদিপাস কমপ্লেক্সস, ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স ইত্যাদি নানা অস্বস্তিকর ধারণার কথা বলেছেন তিনি। সব বোঝে না সে।
#
দরজায় প্রচন্ড আওয়াজ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কে বা কারা যেন তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। ঘুমের অতলে তলিয়ে ছিল সে। ফ্রয়েড যাকে অবচেতন বলেছেন। অবচেতন থেকে চেতনায় ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তার মন। এবার শব্দটা আরো জোরালো মনে হচ্ছে। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো পৃথা। টেবল ঘড়িটার দিকে নজর পড়ল। পৌনে দুটো। হঠাত তার খুব ক্ষিদের অনুভব হোল। মায়ের গলা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে এখন সে। সে উঠে দরজা খুলে দিল। মা ও বাবা দুজনেই উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে । মা বুকে টেনে নিয়ে বললেন,’ এই জন্য বলি দরজা খিল দিয়ে পড়িস না। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিস। এমন করতে আছে? শরীর ভেঙে যাবে যে!’ পৃথা এদিকওদিক তাকালো। সেই লম্বা সুপুরুষ মানুষটা কই? মাকে জিজ্ঞেস করল-উনি কি চলে গেছেন?
-তুই আবার স্বপ্ন দেখছিলি?
পৃথা কিছু বলল না। এরপর কি কথা হবে মাবাবার মধ্যে সে জানে। একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে কাউন্সেলিং-এর জন্য নিয়ে যাওয়া। পৃথা রাজী হবে না। তর্ক চলতেই থাকবে।
সামান্য কিছু খেল। এত রাতে বেশি খেলে হজমের অসুবিধা হবে। এক গ্লাস দুধ খেতেই হোল।
এবার শুতে হবে। আর স্বপ্নের জগতে এস্কেপ করা নয়। সামনে সেমিস্টার আছে। ভাল না করলে জব পেতে অসুবিধা হবে। বিছানা মোটামুটি করাই ছিল। মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়ল সে। বালিশে মাথা দিয়ে পাশ ফিরে শুল। কিন্তু আজ সহজে ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। তার মনে মনে অনেকদিনের পোষা ইচ্ছে ছিল সত্যজিতের সাথে দেখা করার।বাস্তবে ।তা হবার নয়।শুধু ভাবত কেন সে আর কয়েকবছর আগে জন্মালো না । শুধু বাঙালি নয় ভারতীয়দের মধ্যেই সত্যজিৎ এক বিরল প্রজাতির মানুষ। এরকম বহুমুখী প্রতিভা খুম কম দেখা যায়। এরকম একজন মানুষের প্রতি ইনফ্যাচুয়েশন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পৃথা কি মনে করে অক্সফোর্ড এডভ্যান্সড খুলে মানেটা দেখল- Infatuation = An intense but short-lived attraction for somebody or something. না, সত্যজিৎ ঠিকই ধরেছেন- এক ধরনের ইনফ্যাচুয়েশান বলা যেতে পারে কিন্তু এই আকর্ষণ মোটেই short-lived নয়। মুগ্ধতা এবং শ্রদ্ধাই ঠিক। এক্ষেত্রে সত্যজিৎ ভুল, সে ঠিক। বেশ খুশি হোল সে মনে মনে। এবার নিশ্চিন্তে ঘুম আসবে। মনে হয় না ঘুমের মধ্যে আবার তিনি এসে হাজির হবেন। চোখ বুজলো পৃথা। আলোটা নেভাল বেডসূইচ থেকে। বাঁদিকে পাশ ফিরে শোওয়া তার বরাবরের অভ্যাস।
মেয়েটি আপন মনে পড়ছিল। সামনে সেমিস্টার আছে। টিপটিপ করে সারা সন্ধ্যে বৃষ্টি পড়ছে। বিকেল থেকে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হওয়া পর্যন্ত একই যায়গায় বসে আছে সে। বৃষ্টি বাড়ছে কমছে। মনের মধ্যে একটা গান অনেকক্ষণ আসাযাওয়া করছে। ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে...’। গলা ছেড়ে গাইতে পারছে না। পড়ায় মন দিতে হচ্ছে তাই। কিন্তু এই জলদগম্ভীর কন্ঠস্বর কার? সে তো দরজা বন্ধ করেই পড়ছে! সেই মা যখন খেতে ডাকবে তখন সে দরজা খুলবে। বন্ধ ঘরে তো কারো ঢোকার কথা নয়। তাহলে কি সে ভুল শুনেছে?
-কি ভাবছ?
এবার সত্যিই চমকে উঠলো পৃথা । ঠিক কানের কাছেই কেউ যেনও কথা বলছে তার সঙ্গে। আর গলাটাও খুব চেনা। কিন্তু এই বৃষ্টির রাতে তার ঘরে কোন মানুষের আসার কথাই নয়। আর একটা ব্যাপার। তিনি স্বর্গে গেছেন তার জন্মের আগে। তাহলে কিভাবে তিনি আসতে পারেন এই সময়ে তার পড়ার ঘরে? পৃথা টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। ঘরের টিউব লাইট জ্বালিয়ে দিল। না কেউ কোত্থাও নেই। একেই কি বিভ্রম বলে? পড়ার টেনশন থেকে এমন হতে পারে। হয়তো তার পড়তে ভাল লাগছে না। মনে মনে এস্কেপ করতে চাইছে। আর এস্কেপ করার তার দুটো যায়গাই আছে। এক -গান আর নয়তো সত্যজিৎ। তার বেশিরভাগ বন্ধুর বয় ফ্রেন্ড আছে। সেই বয়ফ্রেন্ডই তাদের এসকেপ রুট। দেবু মানে দেবলিনা বলে টাইম পাস। ক্লাশ নাইনের শেষের দিক থেকে নানাজনের কাছ থেকে প্রস্তাব এসেছে কিন্তু সে মোটেই আগ্রহী নয়। এজন্য আড়ালে তাকে অনেকে পিসি বলে। তার কিছু যায় আসে না। এইসব ফালতু টাইম পাস থেকে সত্যজিতে ডুবে যাওয়া অনেক আনন্দের।
- তুমি শুনলাম ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলেছ আমার নামে?
না এবার পৃথার একটু ভয় ভয় করছে। এ খবরটাও পৌঁছে গেছে ওঁর কাছে? কিভাবে গেল? ওখানেও কি এখন ইন্টারনেট চালু হয়েছে?
-একটু ঘাবড়ে গেছ মনে হচ্ছ?
-সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? এতক্ষণে কিছু একটা কথা বেরোল মুখ থেকে।
- ফেলুদা কি বলে? ঘাবড়ে যাওয়া কি স্বাভাবিক মনে করত ফেলু মিত্তির?
-সে আপনি জানেন। ফেলু মিত্তির তো আপনার সৃষ্টি ।
-মোটেই না। আমি কাউকে সৃষ্টি করি নি। ওরা নিজেদের খুশিতেই এসে হাজির হয়েছে।
-ঠিক বুঝলাম না। ফেলুদা, তপসে , জটায়ু এরা আপনার সৃষ্ট চরিত্র নয়?
-একটা অন্য কথা বলা যাক। তুমি অঙ্ক পছন্দ কর?
-খুব
-তুমি অঙ্কের প্রব্লেমগুলো বানিয়েছো?
-না, সে আবার হয় নাকি?
-কেন হবে না? ধর তুমি অনেকদিন ধরে অঙ্ক কষতে কষতে একদিন নিজেই কিছু নতুন ফর্মুলা বানিয়ে ফেললে। এমন হতে পারে তো?
পৃথা ভেবে দেখল কথাটা সত্যি। জ্ঞান তো এভাবেই বাড়ে। সে তাই বলল-
-হতে পারে। ঠিক বলছেন আপনি।
-ফেলু মিত্তিরও ওইভাবে এসে হাজির হয়েছে।
-আপনি খুব ডিটেকটিভ গল্প পড়তে ভালবাসতেন?
-অবশ্যই। তুমি বাসো না?
-তা আর বলতে? ফেলুদা সিরিজের সব কটা বই আমি অনেকবার করে পড়েছি।
-ফেলুদা সিরিজ? আমার তো ফেলুদা নয়। হাহাহাহা। হ্যাঁ প্রদোষ মিত্র বলতে পারো। ফেলু তোমার খুব পছন্দ?
-দারুণ! কিন্তু একটা ব্যাপার আমার পছন্দ নয়। এতো সিগারেট খায় কেন?
-একটা কারণ আছে। কাউকে যদি না বল তাহলে চুপিচুপি তোমাকে বলি।
-না, কাউকে বলব না কিন্ত একটা সমস্যা আছে। দুজনকে বলতে হবে। দেবু আর দেবীকে বলতে হবে।
-ও হো , বুঝেছি-ত্রিনয়নীর বাকি দুজন।
-আপনি কি করে জানলেন?
-আমি জানি। কিভাবে জানি সে অবান্তর কথা। এই যেমন তুমি গান গাও সুন্দর। কিভাবে গাও জানো? আমি তো গাইতে জানি না।
-আপনি আমার সাথে মজা করছেন। আপনি একজন বিশ্ববিখ্যাত সংগীত পরিচালক। আর গান জানেন না?
-রমাকান্ত আচরেকারের নাম শুনেছো?
-শোনা শোনা লাগছে কিন্তু প্লেস করতে পারছি না।
-শচীন তেন্ডুলকরের কোচ। নিজে এমন কিছু খেলোয়াড় ছিলেন না। আমিও ওই রকম। সঙ্গীত পরিচালনা করেছি কিন্তু নিজে গাইতে জানতাম না। তবে প্রচুর গান শুনেছি।
-বিদেশী অর্কেস্ট্রা মিউজিক বেশী শুনেছেন পড়েছি। গান শোনার খুব নেশা ছিল আপনার। বাক, মোৎজারত, আর একজন রাশিয়ান- কি যেন নাম মনে পড়ছে না।
-ঠিক। তবে বাংলাগানের মধ্যেই আমি কিন্তু বড় হয়ে উঠেছি। রবীন্দ্র সঙ্গীত , ব্রাহ্ম সঙ্গীত
-জানি
-খুব মুস্কিলে ফেললে তো তুমি! যা বলছি বলছ -জানি।
-না মানে আমি বলতে চাইছি যে আমি এসব কথা পড়েছি। এবার বলুন চুপিচুপি কি কথা বলতে চাইছিলেন।
-ওই সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা। ফেলু মিত্তির কেন এত সিগারেট খায়
-ও এই ব্যাপার! জানি তো! আপনি নিজে এত স্মোক করেন বলেই ফেলুদাকে সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছেন।
-আমি শিখিয়েছি?
- তা নয় তো কি?
-উড়ে বাব্বা! তুমি তো বেশ বকুনি দিতেও পারো।!!
-দেখুন কাজটা মোটেই ভাল করেন নি। সিগারেট খওয়া মোটেই ভাল নয়।
-দেখ, সিগারেট ছাড়া আমি এত কাজ করতে পারতাম না।
-রবীন্দ্রনাথ সিগারেট খেতেন? সক্রেতিস? বুদ্ধদেব?
-আমি চললাম। এই সব মানুষদের সাথে আমার কোন তুলনাই হবে না।
-না না, ও কথা থাক। তাছাড়া এখন বলে লাভও নেই। আপনি তো----
-ও তাইতো- আমি তো নেই! তাহলে তুমি এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছো?
পৃথা মুস্কিলে পড়ে গেল। ঘরে তো কেউ নেই। কার সঙ্গে কথা বলছে সে? কিন্তু দিব্যি সবকথা শুনতে পেয়েছে সে। আচ্ছা, একটা ফোন করলে কেমন হয় দেবুকে? জেগে আছে কি এখন? কত রাত হবে? ঘড়ির কাঁটা চলছে না। ব্যাটারীব বদলাতে হবে। দেবী কি হস্টেলে? না, তার ইদানিং খুব ভুল হচ্ছে- দেবু হস্টেলে থাকে কিন্তু দেবী পিজি থাকে। বন্ধুরা দেবু শুনলে ভাবে বুঝি কোন ছেলের নাম। পৃথা মুচকি হাসে। একটু রহস্য থাকা ভাল জীবনে। এই তো সেদিন ফারজানা জিজ্ঞেস করছিল,’ হ্যাঁরে , তুই প্রায়ই দেবুর সাথে কথা বলিস। তোর নতুন বয়ফ্রেন্ড?’’ পৃথা হেসে বলে,’ নতুন বল আর পুরোনো বল , আমার ওই একটাই ---‘
-কি করে?
-এগ্রিকালচার পড়ে।
-শেষে আর কিছু পেলি না? এগ্রিকালচার? আর কোনো কালচার পেলি না?
-তাই বলে জোটে না! তাও একজন জোর করে জুটিয়ে দিয়েছে, তাই।
না, এদের অন্য কিছু বুঝিয়ে লাভ নেই। এদের চিন্তাভাবনা একমাত্রিক- ওয়ান ডাইমেনশনাল। ছেলে বন্ধু মানেই বয় ফ্রেন্ড। আর দেবু মানেই ছেলে! হাহাহাহাহা। দেবুকে বলায় তার হাসি আর থামেই না। অবশ্য একটা কথা বলতেই হবে- দেবু আসলে একটি টমবয়। যা সব কান্ডকারখানা করে। এইতো সেদিন কুকুরের কান মুলে দিয়েছিল।
দেবুকে ফোন ঘোরালো। বেজেই যাচ্ছে । হয়তো ও ঘুমিয়ে পড়েছে। দেবীকে ট্রাই করল। একই অবস্থা। বেজেই চলেছে ওদের ফোন।
-হ্যালো স্যর, আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমার গলা? আপনি মানে সত্যজিৎ রায় -শুনতে পাচ্ছেন আমার গলা?
না, কোন সাড়া নেই। সিগারেট খাওয়া নিয়ে অত কথা না বললেই হোত। তার একটা গভীর দুঃখ ছিল -কেন সত্যজিতের সঙ্গে একবার দেখা হোল না! অবশেষে তিনি নিজে এসে হাজির হলেন আর সে কিনা সিগারেট নিয়ে কড়া কথা শুনিয়ে দিল! এটাও কি এক ধরণের গোঁড়ামি নয়?
-তুই বড্ড বাড়াবাড়ি করিস, পৃথা । দেখবি তোর বরও সিগারেট খায়। কি করবি তখন? দেবী বলেছিল একদিন।
দেবুও সায় দিয়েছিল।
-আমার তো খুব ইচ্ছে করে খেয়ে দেখতে। কেন ছেলেরা সিগারেট খায় জানতে চাই বুঝতে চাই। দেবুকে থামিয়ে দিয়ে পৃথা বলেছিল-কেন লোকে খুন করে সেটা বোঝার জন্য তুই কি খুন করে দেখবি? আর আমার বরের কথা বলছিস? বিয়েই করব না তো বর আসবে কোত্থেকে?
-ঠিক বলেছিস ওসব ঝামেলার মধ্যে না যাওয়াই ভাল। দেবু পৃথাকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু দেবী মিটিমিটি হাসছিল।
-তুই অমন পিত্তি জ্বলানো হাসছিস কেন রে? পৃথা খুব রেগে গিয়েছিল। দেবী হাসতে হাসতেই বলেছিলঃ এই বয়সে বেশিরভাগ মেয়েই বলে বিয়ে কোরব না। কিন্তু একবার ভেবে দেখ আমাদের মায়েরাও এই বয়সে তোর মতই ভেবেছিল। বাস্তবে যদি বিয়ে না করত আমরা আসতাম কিভাবে এই পৃথিবীতে ? সবাই যদি এ ব্যাপারে সিরিয়াস হয় একদিন পৃথিবী থেকে মানব প্রজাতি মানে হোমো সাপিয়েন্স বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
-যাবে তো যাবে। আমার বয়েই গেছে মানব প্রজাতিকে রক্ষা করার জন্য বিয়ে করতে। দেবু ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠল। ওর বলার ধরনে সকলেই হো হো করে হেসে ফেললো ।
কিন্তু সত্যজিৎ কোথায় গেলেন? এ বড় অন্যায়। এভাবে আসতেই বা কে বলেছিল আর এলেনই যখন এরকম রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যাবার দরকার ছিল কি?
-আমাকে তুমি ডেকেছিলে তাই তো এসেছি। আর উধাও তো হয়ে যাই নি- তোমাদের তিন বন্ধুর কথা শুনছিলাম।
-আপনি সব শুনেছেন?
-হ্যা-আ-আ। দেবলিনা থুড়ি তোমাদের দেবুটা বদ্ধ পাগল মনে হোল। খানিকটা তোমার মত। কুকুরের কান মূলে দেবার কথাটা সত্যি? বেশ মজাদার মেয়ে তো।
-না না, ও কান মূলে দেয় নি। একটা কুকুর ওকে কামড়ে আঁচড়ে দিয়েছিল। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা ওকে ক্ষেপাই যে -তুই নিশ্চয় কুকুরটার কান মূলে দিয়েছিলি। শুনলেই ও ক্ষেপে যায়।
-তোমার মতই পাগল দেখছি।
-আমি পাগল? এমন বলতে পারলেন?
-হ্যাঁ , পারলাম । কারণ সত্য কথা বলা উচিত। ওই মেয়েটা, মা লক্ষীর মত মুখখানা- দেবাঙ্গী ও খানিকটা স্বাভাবিক মনে হল।
-দেবী? স্বাভাবিক?
-তুলনামুলকভাবে। কোনো সত্যই এবসলিউট নয়। তোমাদের তুলনায় স্বাভাবিক। যেমন ধর---
-যেমন?
-যেমন ও তোমাদের দুজনের মত এন্টি-বিয়ে নয়
-তার মানে আপনি বিয়ে সমর্থন করেন?
-অবশ্যই-তবে মানব প্রজাতির জন্য নয়- নিজের জন্য।
-আমাকে পাগল মনে হয় আপনার? কি দেখে পাগল মনে হয়?
-বলতে পারি যদি রাগ না কর।
-না, রাগ কোরব না। আমি পাগল নই।
-সব পাগলই তাই মনে করে। তোমাদের দেবুও। যাক গে তর্কে তর্ক বাড়বে মাত্র। কাজের কথায় আসি। তুমি কেন পাগল তাই বলি
-বলুন। আমি জানি আমি পাগল নই
-হাহাহাহাহাহা। একদম ঠিক কথা। একটা মেয়ে- টীনেজার- সে তার বড় হয়ে ওঠার সময় আমাকে হিরো ওয়ারশিপ করতে শুরু করল। এটা পাগলামি নয়? আমি আর দ্বিতীয় কোন মেয়ের সন্ধান পাই নি যে তোমার মত
-আপনি এটাকে পাগলামি মনে করেন?
-নয়?
- না, একে বলে মুগ্ধতা। আপনার প্রতিভাকে আমি সম্মান করি। এটা এক ধরণের হিরোওয়ারশিপ বলতেও পারেন কিন্তু আপনি জা ভাবছেন মোটেই তা নয়।
-ইন্টারেস্টিং! বেশ আমি কি ভাবছি তাই বল। আমার বেশ লাগছে তোমার সাথে কথা বলতে।
-আপনি ভাবছেন এটা আপনার প্রতি আমার ইনফ্যাচুয়েশান
-নয়?
-না। শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতা মানেই ইনফ্যাচুয়েশন নয়
-আচ্ছা ধর, যদি এমন হোত যে আমার সাথে তোমার দেখা হয়ে গেল - তুমি কি চাইতে আমার কাছে?
পৃথা এবার মুস্কিলে পড়ল। তাই তো যদি তাই হোত তাহলে কি চাইত সে?
-কি হোল? উত্তর নেই যে। কি চাইতে তুমি?
-আপনার সহকারী হতে চাইতাম। কাজ শিখতাম।
-আমি যদি তোমাকে কোন একটা ছবিতে রোল দিতে চাইতাম তুমি কোন রোল চাইতে?
-নায়ক ছবিতে শরমিলা ঠাকুরের রোল চাইতাম।
-ইন্টারেস্টিং।
-যখন আরো ছোট ছিলে -ধরো আট বা নয় বছর বয়সে তখন যদি বলতাম দুর্গার চরিত্রে অভিনয় কর - রাজী হতে?
-না।
-না? দুর্গাকে তোমার পছন্দ নয়?
-পথের পাঁচালি দেখে এখনো আমি কাঁদি। দুর্গাকে মেরে দিলেন কেন?
-আমি? বিভূতিবাবুকে বল। আমি কেন মেরে দেব?
-আপনি তো বদলে নিতে পারতেন গল্পটা।
-বিভূতিভূষণের লেখা আমি বদলে নেব? আমি কি পাগল? তাছাড়া পথের পাঁচালিতে প্যাথোজ- বিষণ্ণতা মূল সুর। সেটা বাদ দিলে ছবির প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না।
-তা না হয় হোল। বুঝলাম আপনার কথা। কিন্তু এর সঙ্গে আমার পাগল হবার কি সম্পর্ক?
-ইনফ্যাচুয়েশন
-বললাম তো ওটা মুগ্ধতা
-মানব সম্পর্ক অনেক জটিল। ইংরাজিতে বললে layered । আমরা যা বুঝি বা বুঝি বলে মনে করি অনেক সময়ই সেটা পুরো সত্য নয়। আর একটু বয়স হোক বুঝবে হয়তো।
-আমি এখন সাবালিকা। আঠেরো পেরিয়েছে
-হাহাহাহাহা। এইটা খুব মজার কথা। তোমার কোন কোন বান্ধবীর চার বা পাঁচ নম্বর রিলেশান চলছে আর তোমার একটাও নেই। তুমি এডাল্ট?
-এডাল্ট হবার সাথে এসবের সম্পর্ক কি?
-এডাল্ট হলে এই প্রশ্নটাই করতে না। আমার নামে তুমি একটা গ্রুপ খুলেছ। কখন? তোমার জন্মের আগেই আমি নেই এই পৃথিবীতে । তুমি তন্ন তন্ন করে আমার খোঁজ খবর নিয়েছ । সব বই পড়েছ। সিনেমা দেখেছো। আমার ছবির গানগুলি গলায় তুলেছ। ইনফ্যাচুয়েশন নয়?
-বেশ । আর কি কি কারণে আমাকে পাগল মনে হয়?
-একটা প্রশ্ন করি?
-করুন।
-এডমান্ড ফ্রয়েডের নাম শুনেছো?
-হ্যাঁ , ওই নামই শুনেছি। আমাদের এক স্যরের কাছে। কিছু পড়ি নি।
-বড় হয়ে ওর একটা বই যদি পারো পড়ে নিও- দি ইন্টারপ্রিটেশান অফ ড্রিমস বা দি সাইকোলজি অফ ড্রিমস।
-নিশ্চয় পড়ব। আমি তো বড় হয়েই গেছি।
-সে তো বুঝতেই পারছি- তুমি দেবু -তোমরা ‘বড়’ হয়ে গেছ। দেবুরও কোনো বয় ফ্রেন্ড জোটেনি শুনলাম।
-আমি বুঝতে পারছি না বড় হবার সঙ্গে বয় ফ্রেন্ডের সম্পর্ক কি!
-কারণ তুমি বড় হও নি। আঠেরো বছরে পা দিলেই কেউ বড় হয়ে যায় না আপনা আপনি- মানে অটোমেটিক্যালি।
-আমি মানতে পারলাম না। আইন বলছে যে আমি এডাল্ট হয়েছি।
-তুমি আমাকে খুব রেস্পেক্ট কর, তাই তো?
-সে তো অবশ্যই।
-যদি বলি আসলে তুমি আমাকে শ্রদ্ধা কর না। ফেলুদার গল্প তোমার ভাল লাগে। আমার কিছু সিনেমা তোমার ভাল লাগে আর আমার সুর দেওয়া গানগুলি তোমার ভাল লাগে। সে তো অনেকেরই লাগে। কিন্তু এতে বোঝায় না যে তুমি আমাকে শ্রদ্ধা কর, অন্যরকম মানুষ মনে কর যে অন্যদের থেকে আলাদা।
-আপনি ঠিক বলছেন না। আমি সত্যিই আপনার গুণমুগ্ধ। আমার সব বন্ধুরা জানে।
-সেতো আমিও জানি আর তা জানি বলেই তো আমি তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি। কিন্তু তুমি আমাকে শ্রদ্ধা কর না
-কি করে বুঝলেন? পৃথা মনঃক্ষুণ্ণ হল। একটু রাগও হোল তার।
-রাগ করবে না তো?
-না।
-তুমি কাপুরুষ ও মহাপুরুষ দেখেছ?
-না
-আগন্তুক?
-হ্যাঁ ।কিন্তু কেন এপ্রশ্ন করছেন?
-এই দুটি ছবিতে ধর্ম , ঈশ্বর ও কুসংস্কার সম্পর্কে আমার মতামত বলার চেষ্টা করেছি। তুমি আধুনিক যুগের মেয়ে হয়েও তাবিজকবচ পর। তার মানে কি ডাঁড়ায় ?
-দেখুন , আমি এসবে বিশ্বাস করি না কিন্তু মাবাবার বিশ্বাসে আমি আঘাত দিতে চাই না তাই পরি।
-দ্বিচারিতা নয় এটা?
-আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি যদি অনুমতি দেন
-অবশ্যই
-আপনি ব্রাহ্ম ধর্মে আস্থাশীল?
-হ্যাঁ
-কারণ আপনাদের পরিবার ব্রাহ্ম, তাই তো?
-এবার বুঝেছি তুমি বেশ তর্কও করতে পারো।
-আর একটা কথা-সিগারেট খাওয়া স্বাস্থের পক্ষে খারাপ জেনেও আপনি দিব্যি সিগারেট খেতেন এবং ফেলুদাকেও সিগারেট ধরিয়েছেন। এটা দ্বিচারিতা নয়?
কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পেল না পৃথা। কেমন এক ঘোরের মধ্যে আছে সে। স্বপ্নেও কোনদিন ভাবে নি যে এভাবে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কথা হবে তার। একটা স্বপ্ন অন্তত পূর্ণ হোল তার। একটা হ্যান্ডশেক করতে পারলে জীবন সার্থক হয়ে যেত। সে তো আর সম্ভব নয়। কিন্তু উনি যে বললেন ওনার প্রতি তার ইনফ্যাচুয়েশন আছে এই ব্যাপারটা নিয়ে তার কিছু পরিমানে দ্বিধা আছে। হ্যাঁ একথা সত্যি যে সত্যজিৎ রায়ের সে ফ্যান- শুধু ফ্যান নয় একনিষ্ঠ ফ্যান। যে মানুষটা ফেলুদার গল্প লেখেন, গুপী গায়েন বাঘা বায়েন এর মত কালজয়ী সিনেমা সৃষ্টি করেন , এত সুন্দর সুর দেন গানের, এত চমৎকার স্কেচ আঁকেন , আরো কত প্রতিভা তার- তার অনুরাগী হওয়াটা গর্বের। কিন্তু ইনফ্যাচুয়েশন? পৃথা সিওর নয়। সিগম্যান্ড ফ্রয়েড তার পড়া নেই। একটা কথা সত্যজিত ঠিক বলেছেন- সব সম্পর্কই লেয়ারড- একাধিক স্তর আছে। কোনটায় স্তরবিন্যাস বেশি কোনটায় কম।
না, স্বীকার করতে দোষ নেই । ইনফ্যাচুয়েশন হতেও পারে। খারাপ কিছু নয়। কোথায় যেন পড়েছে সে যে আমরা বড় হই মানে নানা স্তরের সম্পর্কের তানাবানার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে করতে যাই। ফ্রয়েড সাহেব তো আরো সব মারাত্মক কথা বলেছেন। ইদিপাস কমপ্লেক্সস, ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স ইত্যাদি নানা অস্বস্তিকর ধারণার কথা বলেছেন তিনি। সব বোঝে না সে।
#
দরজায় প্রচন্ড আওয়াজ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কে বা কারা যেন তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। ঘুমের অতলে তলিয়ে ছিল সে। ফ্রয়েড যাকে অবচেতন বলেছেন। অবচেতন থেকে চেতনায় ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তার মন। এবার শব্দটা আরো জোরালো মনে হচ্ছে। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো পৃথা। টেবল ঘড়িটার দিকে নজর পড়ল। পৌনে দুটো। হঠাত তার খুব ক্ষিদের অনুভব হোল। মায়ের গলা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে এখন সে। সে উঠে দরজা খুলে দিল। মা ও বাবা দুজনেই উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে । মা বুকে টেনে নিয়ে বললেন,’ এই জন্য বলি দরজা খিল দিয়ে পড়িস না। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিস। এমন করতে আছে? শরীর ভেঙে যাবে যে!’ পৃথা এদিকওদিক তাকালো। সেই লম্বা সুপুরুষ মানুষটা কই? মাকে জিজ্ঞেস করল-উনি কি চলে গেছেন?
-তুই আবার স্বপ্ন দেখছিলি?
পৃথা কিছু বলল না। এরপর কি কথা হবে মাবাবার মধ্যে সে জানে। একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে কাউন্সেলিং-এর জন্য নিয়ে যাওয়া। পৃথা রাজী হবে না। তর্ক চলতেই থাকবে।
সামান্য কিছু খেল। এত রাতে বেশি খেলে হজমের অসুবিধা হবে। এক গ্লাস দুধ খেতেই হোল।
এবার শুতে হবে। আর স্বপ্নের জগতে এস্কেপ করা নয়। সামনে সেমিস্টার আছে। ভাল না করলে জব পেতে অসুবিধা হবে। বিছানা মোটামুটি করাই ছিল। মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়ল সে। বালিশে মাথা দিয়ে পাশ ফিরে শুল। কিন্তু আজ সহজে ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। তার মনে মনে অনেকদিনের পোষা ইচ্ছে ছিল সত্যজিতের সাথে দেখা করার।বাস্তবে ।তা হবার নয়।শুধু ভাবত কেন সে আর কয়েকবছর আগে জন্মালো না । শুধু বাঙালি নয় ভারতীয়দের মধ্যেই সত্যজিৎ এক বিরল প্রজাতির মানুষ। এরকম বহুমুখী প্রতিভা খুম কম দেখা যায়। এরকম একজন মানুষের প্রতি ইনফ্যাচুয়েশন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পৃথা কি মনে করে অক্সফোর্ড এডভ্যান্সড খুলে মানেটা দেখল- Infatuation = An intense but short-lived attraction for somebody or something. না, সত্যজিৎ ঠিকই ধরেছেন- এক ধরনের ইনফ্যাচুয়েশান বলা যেতে পারে কিন্তু এই আকর্ষণ মোটেই short-lived নয়। মুগ্ধতা এবং শ্রদ্ধাই ঠিক। এক্ষেত্রে সত্যজিৎ ভুল, সে ঠিক। বেশ খুশি হোল সে মনে মনে। এবার নিশ্চিন্তে ঘুম আসবে। মনে হয় না ঘুমের মধ্যে আবার তিনি এসে হাজির হবেন। চোখ বুজলো পৃথা। আলোটা নেভাল বেডসূইচ থেকে। বাঁদিকে পাশ ফিরে শোওয়া তার বরাবরের অভ্যাস।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন