কেমন আছে শহর বর্ধমান ?
এখন মিনিট পনেরো এক নাগাড়ে বৃষ্টি হলে বর্ধমান শহরটা জাদুবলে ভেনিস হয়ে যায়। এমনকি বিজয় তোরণের এ পাশেও জল জমে। বাকি শহরের কথা বলার দরকার নেই। যারা শহরের ওইসব অঞ্চলে বসবাস করেন তারা জানেন। আমি এরকম পঞ্চাশটা অঞ্চলের নাম বলতে পারি। এক নাগাড়ে ৬৫ বছর এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দা আমি। হাতের তালুর মত শহরটা চিনি।বছর চল্লিশ আগে ‘উদয় অভিযান’ পত্রিকায় একটা প্রতিবেদন লিখেছিলাম। প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল বর্ধমানের নগর পরিকল্পনা ও পয়ঃপ্রণালী সংস্কার ও জলনিকাশি প্রকল্প। লিখেছিলাম এই এলোমেলো ভাবে গড়ে ওঠা শহরটাকে যদি এখনই নজর না দেওয়া হয় তাহলে একদিন শহরটা জতুগৃহ হবে এবং সামান্য বৃষ্টিতে জল জমবে এমনকি বিজয় তোরণের কাছে বিসি রোডের উপর। উদ্যোগী ব্যবসায়ীরা রবারের নৌকা কিনে রাখতে পারেন। বর্ধমান নর্দমার জলে ভেনিস হবে। অনেকদিন ধরে আমাকে এজন্য নানারকম ঠাট্টা বিদ্রূপ শুনতে হয়েছে। পরে যখন সত্যিই জল জমতে আরম্ভ করল তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।
২০০০ সালে লায়ন্স ক্লাবে একটা সেমিনার হয়- একবিংশ শতকের বর্ধমানের নগর পরিকল্পনা নিয়ে। সেই সেমিনারে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ততকালীন উপাচার্য ডঃ মোহিত চট্টোপাধ্যায় ও আমি বক্তা ছিলাম। মোহিত বাবুর গবেষণার বিষয়ের মধ্যে নগর পরিকল্পনা ও নগর উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমি মাঠে চরা মানুষ। বেশ মজা হয়েছিল। উনি একটা তথ্য দিয়ে দেখালেন যে দামোদরের বিধ্বংসী বন্যায় ইদিলপুর নামে গ্রামটি মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ২০০০ সালে ইদিলপুর একটা জমজমাট লোকবসতি –এ খবর তাঁর তথ্যসূত্র জানায় নি। আমি সে কথা উল্লেখ করে বললাম যে শুধুমাত্র তাত্বিক প্রকল্প দিয়ে নগর পরিকল্পনা করা যায় না। যেখানে এই সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হচ্ছিল সেখানে একটা বড় ডোবা ছিল। বললাম,’ আপনারা এই শহরকে বাঁচানোর পরিকল্পনা করছেন কিন্তু এই বিল্ডিংটাই তো জলাজমি বুজিয়ে নির্মাণ করা।‘ বলাবাহুল্য আমাকে আর কোনদিন সিংহবাহিনী ডাকেন না।
#
এই শহরের সকল চিন্তাশীল মানুষের মনের মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা বাসা বেঁধে আছে যে এই শহরটা একেবারেই অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেছে শুরু থেকেই। কথাটা খানিকটা ঠিক; অনেকটাই ঠিক নয়। আমার মতে এই শহরের সর্বনাশের শুরু স্বাধীনতার পর থেকে। জমিদারী বা রাজ আমলে এই শহরের নগর পরিকল্পনা কিছু ছিল না একথা ঠিক কিন্তু এই শহরের জলনিকাশি পরিকল্পনা ছিল একেবারে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। শহরটার গঠন ছিল উল্টোনো বাটির মত কানিকটা। যতই বৃষ্টি হোক- এমনকি প্রবল বর্ষণেও- শহরের জল দশ মিনিটের মধ্যে সরে যেত । কৃষ্ণসায়র , শ্যাম সায়র, রাণী সায়র কোনোদিন উপচে ভেসে যায় নি। বাঁকা তখন দুরন্ত বর্ষাতি নদী ছিল; এখন আমরা এটাকে পূতিগন্ধময় নর্দমায় রূপান্তরিত করে ফেলেছি, বাঁকার দুই পাড়ের জমি( বাঁকার বেসিন) আত্মসাৎ হয়ে গেছে।নগরপালকদের অদূরদর্শিতা, মানুষের সীমাহীন লোভ ও জমির ক্ষুধা, এবং বন্ধ্যা রাজনীতির কারণে এই শহরটা আর বাসযোগ্য নেই, একটা বদ্ধ জতুগৃহ এটা, দশমিনিটের বৃষ্টিতে এই শহর নর্দমার জলে ভেনিসে পরিণত হয়ে যায়। উলটানো বাটিকে আমরা উলটে নিয়েছি। তাই এখন রাণীগঞ্জ বাজারেও জল জমে সামান্য বৃষ্টিতে। কে দায়ী? উত্তর- আমরা সকলে। আমি ৬৫ বছর এই শহরে বাস করি। এরমধ্যে মাঝখানে একটানা ৩৪ বছর এবং তার আগেও দশ বারো বছর অর্থাৎ প্রায় পঞ্চাশ বছর পুরসভার দায়ীত্বে ছিলেন বামপন্থীরা । দায়ীত্ব কেউ এড়িয়ে যেতে পারেন না। আজ গাছকাটার বিরুদ্ধে ও সুস্থ নাগরিক জীবনের সন্ধানে সেমিনার মীটিং করতে শুরু করেছি। ভাবতে ভাবতে কিছু কথা মনে ভেসে এল। এলোমেলোভাবে কিছু কথা বলার ইচ্ছেয় এই প্রতিবেদন। ( চলবে )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন